খাঁচার ভিতর অচিন পাখি লালন গীতি
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মনবেড়ি
দিতাম পাখির পায় ।
আট কোঠরি নয় দরজা আঠা
মধ্যে মধ্যে জোরকা কাঁটা
তাহার উপরে সদর কৌটা
আয়নামহল তাই ।
কপালের ফের নইলে কি আর
পাখিটার এমন ব্যবহার
খাঁচা ছেড়ে পাখি আমার
কোন বনে লোকায় ।
মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তুর কাঁচা বাঁশে
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয় ।
এই গানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে মানুষ লালন সাঁইজীকে চিনেছেন বেশি। তাই আজকে আমরাও খাঁচার ভিতর অচিন পাখি লালন গীতি সম্পর্কে ভাব সমূহ তুলে ধরার চেষ্টা করবো ।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
আমাদের মানব জীবনে এই দেহ খানা হচ্ছে একটি খাঁচা। যে খাঁচার সুন্দর দর্শন দিয়েছেন মহাত্মা লালন ফকির। আমরা এই দেহটা কে সাধারণ মনে করি যেমন খাই, ঘুমায়, চলি ফিরি।
কিন্তু এই দেহের সম্পর্কে বিরাট এক দর্শন দিয়ে গেলেন এই খাঁচার ভিতর অচিন পাখি এই গানের মধ্যে দিয়ে। তাই এই লালন গীতি গুলি হলো দেহতত্ত্ব গান। আমরাও আজকে জানার জন্যে এসেছি এই গানের মাহাত্ম্য কি।
এই দেহ খাঁচার মধ্যে অচিন পাখি কেমনে আসে যায়। অচিন পাখি হলো প্রাণ বা আত্মা। যে প্রাণ বাতাসের আকারে নিঃশ্বাসের মাধ্যেম আসা যাওয়া করছে প্রতি নিয়তনাসিকা দিয়ে। তিনি আসছেন আর যাচ্ছেন।
তাই বলা হয়েছে কেমনে আসে যায়। এই বাতাস রূপে পাখিটা চাইলেও ধরা যায় না। কারণ তাকে আমরা চিনি না বা সম্যকভাবে জানিনা। আমরা চাইলেও বাতাস আকারে নিশ্বাসকে জোর করে ধরে রাখতে পারবো না।
যদি জানতে পারতাম বা পাখিকে চিনতে পারতাম তাহলে তাকে মনের বাঁধন দিয়ে ধরে রাখতাম । যদি মনের বাঁধন দিয়ে ধরতে পারতাম তাহলে এই মানব জনম সফল সারর্থক হত ।
আরও পড়তে পারেনঃ সময় গেলে সাধন হবে না দিন থাকিতে দ্বীনের সাধন কেন করলে না
আট কোঠরি নয় দরজা আঠা মধ্যে মধ্যে জোরকা কাঁটা
মানব দেহ বড়ই আজব এক ঘর। যে ঘরের মধ্যে কি কি রয়েছে আমরা তা নিজেরাও জানিনা । কিন্তু বাউল সাধক লালন সাঁইজি এই দেহের মধ্যে বিরাজমান অনেক কিছুর সন্ধান দিয়েছেন ।
যেমন আট কুঠুরী । এই মানব দেহের মধ্যে আট কুঠুরি কি অনেকে কিন্তু জানেনা । আট কুঠুরি হলো দুই চোখ, দুই নাক দুই কান এবং একটি হলো লিঙ্গ দ্বার আরেকটি হলো গুহ্যদ্বার বা মলদ্বার ।
সর্বমোট এই আটটি দরজা বা কুটুরি বলেছেন সাধক। প্রাণ এই আট দরজা দিয়ে প্রাণ আসে আর যায়। অনেকের এই আট কুটুরি দিয়ে মৃত্যু হয় বা প্রাণ ত্যাগ হয়। মধ্যে মধ্যে জোরকা কাঁটা ।
মধ্যে জোরকা কাঁটা মানে হলো বন্ধনী রয়েছে যা সরাসরি কুঠুরি দেখা যায় না। কিন্তু ছিদ্র রয়েছে যা দিয়ে প্রাণ চলে যায় মৃত্যুর সময় ।
তাহার উপরে সদরকৌটা আয়নামহল তাই
নিজের স্বরূপ চেনা যায়। এই উপরে যাওয়ার পদ্বতি হলো মনকে উর্দ্ধগামী করা। আর মন উর্দ্ধগামী হলেই পাখিকে ধরা যাবে। অচিন পাখিকে চেনা যাবে। আমাদের মানব দেহ সম্পর্কে জানা যায় এবং নিজেকে সম্যকভাবে অবগত হওয়া যায় ।
আরও জানতে পারেনঃ মনেরে বুঝাব কত, যেই পথেতে মরণ ফাঁসি
কপালের ফের নইলে কি আর পাখিটার এমন ব্যবহার খাঁচা ছেড়ে পাখি আমার কোন বনে লোকায় ।
প্রথমে আমাদের কপাল সম্পর্কে জানতে হবে। যদিও বাউল সঙ্গীতের রূপক কথা কিংবা সাধারণ কথাগুলির ভিতর অনেক ত্ত্ব লুকিয়ে থাকে। এখানে কপাল ফের বলতে মানুষের সারাজীবনের কর্মফলের কথা বলা হয়েছে।
আমার আপনার সবার কর্মফলের উপর জীবন নির্ধারণ হয়। আমাদের জীবনের কর্মফল বলতে আমরা যা ভাল কর্ম করবো সেই ভাল কর্মের ফল আমরা অবশ্যই ভোগ করবো।
কিন্তু সাঁইজির এই কথার মধ্যে বললেন " কপালের ফের নইলে কি আর পাখিটার এমন ব্যবহার " আমাদের জীবনের ভাল কর্মফল নেই বলে আমরা অচিন পাখির সম্পর্কে ভালো কিছু জানতে পারছি না।
অথবা এই খাঁচার অচিন পাকিকে ধরতে পারলাম না। যদি এই মন দিয়ে আমাদের চিন্তা শক্তি উন্নত হত বা তাকে ধরার চেষ্টা বা কলাকৌশল শিখতাম গুরু কাজথেকে, তাহলে অচিন পাখি আমাদের সাথে আর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাতো না।
খাঁচা ছেড়ে পাখি আমার কোন বলে লোকায়। দেহ খাঁচার পাখি কখন কোথায় চলে যায় আমরা সেই হদিস পাই না। কখন কোথায় আমাদের মন চলে যায় এই নিঃশ্বাসের সাথে সাথে আমরা কখনো তার এই স্বভাব ধরতে পারলাম না ।
মন তুই রইলি খাঁচার আশে খাঁচা যে তুর কাঁচা বাঁশে কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে ফকির লালন কেঁদে কয়
মন সর্বদা দেহের প্রতি পড়ে থাকে। ভাল খাওয়ার জন্যে, ভাল থাকার জন্যে এবং ভাল চলার জন্যে। মানুষ নিয়ত যুদ্ধ করছে শুধু দেহের জন্যে। কিন্তু একটি পরম সত্য থেকে আমরা বার বার বিচ্যুত হচ্ছি সেটি হচ্ছে আত্মা কে জানা বা আত্না সম্পর্কে সুচিন্তা করা ।
আমরা কেন জন্মগ্রহণ করেছি আমাদের আসলে সঠিক কাজ কি, কেন আমরা এই ভ্রমে আছি এই পরম সত্যের পন্থা উদ্ঘাটন করা মানবের কর্তব্য। তাই সাঁইজি বলেছেন মন তুই রইলি খাঁচার আশে, খাঁচা যে তুর কাঁচা বাঁশে ।
আসলে আমাদের চিন্তার কথা হচ্ছে, যেই কাঁচা বাঁশের খাঠিয়া নিয়ে কবরে, শ্মশানে নিয়ে যাবে সেই চিন্তা করা। আমাদের মৃত্যুর চিন্তা করা নিত্যদিন অতীব প্রয়োজন ।
প্রতিদিন মৃত্যু চিন্তা করলে নিজের সম্পর্কে আর কোন অহমিকা বা অহংকার থাকে না। পরন্তু পরম সত্যকে জানার আগ্রহ আরো দ্বিগুন হবে। কারণ আমাদের এই খাঁচা একদিন খসে পরে যাবে ।
অর্থাৎ আমাদের এই দেহ খাঁচার একদিন ধ্বংস হবেই। তাই এই দেহ খাঁচার সাধনা না করে কাঁচা বাঁশের খাঁচার কথা স্মরণ করা বেশি কর্তব্য। তাহলে আমাদের সেই খাঁচার অচিন পাখিকে সহজে ধরা যেত ।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি লালন গীতি সারমর্ম
এই মানব দেহ খাঁচা থেকে অচিন পাখি নিত্যদিন নিত্যসময়ে আসে আর যায়। এই আসা যাওয়ার ভিতরে মানুষের মৃত্যু রচনা রয়েছে। তবে এই যে প্রাণ বায়ু প্রতি মুহুর্মুহু যাওয়া আসায় ব্যস্ত থাকে তা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করার জন্যে এই গানের রচনা ।
সাঁইজি নিজের এই দেহকে বলছেন খাঁচা আর আমাদের প্রাণবায়ু মানে স্বাস-প্রশ্বাস হল খাঁচার পাখি। কত সুন্দর করে এই গানের রচনা করেছেন। কিন্তু তাৎপর্য অনেক গভীর ।
তিনি কেবল মানুষের জীবনে সচেতন হওয়ার জন্যে গান লিখেছেন। এই গানটি ও ঠিক তেমন একটি নিদর্শন। আমাদেরকেও সবসময় খাঁচার চিন্তা করলে হবে না। সেই অচিন পাখিকে জানার জন্যে চেনার জন্যে সর্বশেষ ধরার জন্যে নিত্য চেষ্টা থাকতে হবে ।
যেই পথ দিয়ে পাখি বার বার আসা যাওয়া করে সেই পথেই তাকে ধরার জন্যে মন্ত্র জানতে হবে না হলে এই জীবনেই বৃথা হয়ে যাবে ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url